সমস্ত লেখাগুলি

বাস্তবে যুক্তিবাদী হতে পারা ও তার প্রয়োগ নিয়ে কিছু কথা -
বিশ্বনাথ মুরমু
Dec. 3, 2024 | যুক্তিবাদ | views:285 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আমরা অনেক সময়ই খুব সাধারণ একটা কথা, খুব সাধারণভাবেই ব্যাবহার করে থাকি, charity begins at home. অর্থাৎ কিনা, বাড়ি থেকেই আসল বিদ্যাশিক্ষার শুরু করতে হয় (এখানে যুক্তিবোধ বা যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা)। আক্ষরিক অর্থে, এক্ষেত্রে শুধু নিজের বাড়ি বা বাড়ির লোকই ধরা হয় না, ধরা হয় প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজন, সহপাঠী, সহকর্মী, ইত্যাদি। কিন্তু, ভেবে দেখলে ধরা পড়বে যে যারা নিজেদের যুক্তিবাদী বলে বা যাদের যুক্তিবাদী বলে লোকে জানে এবং যারা যুক্তিবাদী নয়, অনেক ব্যাবহারিক ক্ষেত্রেই তাদের সবার আচরণ এক হয়ে দাঁড়ায়, যা হল অযৌক্তিক অনেক কিছুই, না দেখার ভান করে থাকা বা অনেক সময় বাধ্য হয়েই চেপে যাওয়া। যারা যুক্তিবাদী নয় তারা তো গড্ডলিকা প্রবাহের লোক, কাজেই কিছু বলারই নেই। কিন্তু যারা জীবন যাপনে আদর্শবাদী, সত্যবাদী, অন্তত নিজেদের সেইভাবে তুলে ধরতে চায়, তাদের যদি গলায় তুলসি মালা, কপালে তিলক দেখা যায়, এটা কি আদর্শবাদী বা সত্যবাদীর আচরণ বলে মেনে নেওয়া যায়? 

এটা হয়ে যায় আর এক প্রবাদের বহিঃপ্রকাশ, তামাকও খাব, আবার ডুডুও খাব। যুক্তিবাদ ছাড়া না আদর্শবাদ মানা যায়, না সত্যবাদের অনুসরন করা যায়। যুক্তিবাদ হল বাস্তবতা, বাস্তবতাই সত্য (এই সত্যই ধর্ম/ন্যায়), এর কোন দরাদরি হয় না। কাজেই, অবাস্তবতার আদর্শবাদ যেমন হতে পারে না, তেমনই অবাস্তবতার সত্যবাদও হতে পারে না।

চাই সচেতনতার পাঠ, প্রসার যা কিনা বিজ্ঞান মঞ্চগুলিই পালন করতে পারে। অবশ্য, এটা সত্যি, সব ক্ষেত্রে এবং সব সময়ে এককভাবে প্রতিবাদ করা যায় না বা যুক্তিটুকুও প্রকাশ করা যায় না। প্রচলিত ধারনার মূলে কুঠারাঘাত করা চাই পাল্টা যুক্তির অর্থাৎ বাস্তবতার ধারনা প্রচার করে। এরজন্য, সব জায়গায় সব সময়ে বিলি করা যায় এমন হ্যান্ডবিল ছাপা থাকলে, বিলি করলে হয়, যা কোন সংগঠনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকলেই ভালো হয়, জোরদার হয়। বড় বড় বই কিনে পড়ে লোকে যুক্তিবাদী হবে, কুসংস্কারের ব্যাবসায়ী ধান্দাবাজরা পিছু হঠবে, এটা আশা করাই হাস্যকর। এবং যে কোন একক প্রতিবাদীই হয় হাসির পাত্র।

যখনই কেউ নতুন বাড়ি বানায়, কর্তা গিন্নি দুজনেরই কল্পনায় থাকে ছোট্ট একটা ঠাকুরঘর। যারা পারে না বা যাদের নেই, তারা একটা কোনে বসিয়ে নেয় ঠাকুরের আসন। কেউ, ঠাকুরের জন্য কাঠের আসন বা সিংহাসন, ফার্নিচারের দোকান থেকে কিনে এনে দেওয়ালে টাঙিয়ে দেন এই আসন। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। চাই যুক্তিবাদী ফার্নিচারের দোকান, যে তার বিঞ্জাপনে লিখে রাখবে, এখানে কোন ঠাকুরের আসন বিক্রি হয় না বা বানানো হয় না। বাড়ি বানানোর সিভিল ইঞ্জিনীয়ার লিখে রাখবে, আমি মানুষের ঘরের প্ল্যান বানাই, ঠাকুরঘরের প্ল্যান বানাই না।

বাড়ির বাচ্চা কোলে করে কাজের মাসি কি আপন মাসি, তাকে ক্যালেন্ডারে ঠাকুর চেনাচ্ছে আর বলছে, নমো কর, নমো কর। কোন ক্যালেন্ডার ওয়ালার কি হিম্মৎ হবে, শুধুই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সূর্য সেন, ক্ষুদিরামের ক্যালেন্ডার বানানোর? সে কি লিখে রাখার হিম্মত দেখাতে পারবে, যে সে ঠাকুরের ক্যালেন্ডার ছাপায় না? একশ' টাকার বিজনেসে তার হয়ত আঠানব্বই টাকাই আসে নানাবিধ ঠাকুরের ছবির (হনুমানেরও হতে পারে) ক্যালেন্ডার বেচে।  আমাদের একমাত্র ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ বলে আমরা সস্তায় ফেসবুকে আলোড়ন তুলতে ব্যাস্ত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের র' জানতে চিনতে অনীহা। কেননা তাতে প্রভূত পরিশ্রম আছে।

বাড়িতে পূজোর আয়োজন হয়েছে। ছোটখোকা ঘোর নাস্তিক। সে তার নিজের ঘর থেকে বেরোবে না। বাড়ি ভর্তি পাড়ার লোক, আত্মীয় স্বজন। বড়খোকার উপর ভার দেওয়া হল, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একঘন্টার জন্য যেন নিয়ে আসে পূজোর ঘরে।

নিজের বাড়ি হোক কি পরের বাড়ি, কাউকে যখন বেরোতে দেখা যায় বাড়ির কোন সদস্য বা সদস্যা হয়ত বলে ওঠেন দুর্গা, দুর্গা। এটা হয় এবং হয়ে থাকে আজন্ম সংস্কার বা শিকড়হীন এক বিশ্বাস থেকে। যেন, রাস্তাঘাটে অদৃশ্য মা দুর্গা তাকে রক্ষা করবেন। যে যাচ্ছে, তার যাত্রার শুভ কামনা করাই উদ্দেশ্য। সেখানে বাস্তবতা মেনে, যাত্রা শুভ হোক বললেই তো হতে পারে। সবচেয়ে বলা ভালো, চোখ কান খোলা রেখে যেও। সত্যিই যা দিনকাল পড়েছে!

বাড়ির লোকজনের মধ্যে কোন একটা বিষয়ে হয়ত আলোচনা চলছে। এমন সময়ে বেয়াদপ টিকটিকি ডেকে উঠল, আর কেউ একজন হাতের আঙুলে তিন তুড়ি মেরে বলল, 'ঠিক, ঠিক, ঠিক'। চোখে ভেসে ওঠে হীরক রাজার দরবার, রাজা তিনজন পারিষদকে পরপর প্রশ্ন করেন 'ঠিক কিনা?' উত্তর আসে, 'ঠিক,' 'ঠিক,' 'ঠিক'।


ছেলেমেয়েরা মা বাবাকে প্রণাম করে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, মা হয়ত বলে উঠলেন, মা সরস্বতীকে স্মরণ করো, তিনি সব ঠিক করে দেবেন। সত্যিই কি তাই? পড়াশুনা না করে থাকলে, কোন দেব বা দেবীই কলমের নিবের ডগায় বসে গড়গড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর লিখিয়ে দেবে না। সরস্বতীর যুক্তিতে, রেজাল্ট খারাপ করা কোন ছাত্রছাত্রীকেই দোষারোপ করা মোটেই ঠিক না।

বন্ধুরা মিলে হুইস্কির আসর বসিয়েছে। জল, সোডা, চিপস্, বাদাম, পেঁয়াজ, আদাকুচি, কোন ত্রুটি নেই আয়োজনে। এক বন্ধু তুখোড় ব্যাবস্থাপনায়। ছিপি খুলে প্রথমেই মাটিতে তিন ফোঁটা ফেলে ভূমি পূজণ সেরে পেগ সাজিয়ে ফেলল। এই ভূমি পূজনটা কেমন বেমানান (সুপারস্টিশন) হয়ে গেল না? নাকি মদ খাওয়ার আনন্দে 'এই একটুখানি' বলে নিজের বিবেককে ফাঁকি দেওয়া যায়?

নার্সিং হোমে রুগী ভর্তি আছে। কয়েক মাসের চেষ্টায় অনেক পরিশ্রমে বেশকিছু অর্থের বিনিময়ে ভর্তির পর আজ অপারেশনের ডেট পাওয়া গেছে। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকবার সময়ে ডাক্তার বলে গেলেন, এখন যা করবার উপর-ওয়ালাই করবেন, তাঁর উপর ভরসা রাখুন। বিজ্ঞান শিক্ষিত ডাক্তার, বিজ্ঞানের অবদান চিকিৎসা বিদ্যাকে হেয় করে উপর-ওয়ালার দোহাই দিলেন। বাড়ির মেয়েরা নার্সিং হোমের নিচতলায় কোন এক দেব বা দেবীর ছোট করে বানিয়ে রাখা মন্দিরে প্রার্থনায় বসে গেলেন। চতুর চূড়ামনি নার্সিং হোম কর্তৃপক্ষ এটাকে কি কায়দা করে বানিয়ে রাখে নি, যাতে করে, রুগীর মৃত্যুতে গাফিলতির অভিযোগ তুলে রুগীর আত্মীয়স্বজন নার্সিং হোম, ডাক্তার নার্সের উপর চড়াও না হতে পারে?


এরকমই, প্রায় সব নার্সিং হোমে, প্রাইভেট হাসপাতালে, পুলিশ ব্যারাকে, থানা চত্বরে, বড় বড় আবাসনে, বাজারে বড় ছোট মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বারা, যারা যেখানে যেমন জমাতে পেরেছে, বানিয়ে রেখেছে। খুব ভালো ভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, এতে করে কেমন ভাবে শাসক এবং শোষক শ্রেনীর স্বার্থই পুষ্টিলাভ করে। তামাম দেশবাসীকে বাসস্থান, অন্ন, বস্ত্রে স্বনির্ভর করা অসাধ্য নয়। অসাধ্য নয় ভালো শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ব্যাবস্থা করা। কিন্তু, তাতে করে ভোট পাওয়ার আশা নাও থাকতে পারে। এবং নিজেরা একচ্ছত্রভাবে সুখের সিংহাসনে বসে ছড়ি ঘোরাতেও পারবে না। তাই, শাসকশ্রেনীর লক্ষ্য থাকে আপামর জনসাধারণকে ভাগ্যবাদী করে তোলা।


ব্যাস্ত জাতীয় সড়কের পাশেই আছে বিপত্তারিনী মন্দির। যাওয়া আসার সময়ে সব বাসের গতি ধীর হয়ে যায়, যাতে গদ্গদ ভক্তবৃন্দ একটাকা দু টাকা দেবীকে উদ্দেশ্য করে মন্দিরের দিকে ছুঁড়ে দিতে পারে। কন্ডাক্টার নিজেও ছুঁড়ে দেয় কয়েন। ওখানে অনেক দু চাকা চারচাকা, নতুন গাড়ি কিনলেই মালিকরা আসেন পূজো দিতে। দেবী নাকি দু চাকা, চারচাকা গাড়ি ও গাড়ির চালক বা আরোহীকে রক্ষা করেন। অথচ এমনও নজির আছে, পূজো দিয়ে ফেরার সময়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নতুন গাড়ি ভেঙেছে, আরোহীদের মৃত্যু হয়েছে।

বাজারের মোড়েই ডানদিকে টিনের চেয়ারে লালশালু ঢেকে বসিয়ে রাখা আছে শনির ফটো, পাশে কাঁসার থালায় কটা জবাফুল, জ্বলন্ত ধূপকাঠি, কিছু কয়েন, দশ বিশ টাকার নোট। তাঁর কোপে না পড়তে হয়, বাজার ফিরতি দশটাকার নোট ফেলে দিলাম অকাতরে। দোকান বন্ধের সময়ে এসে নজর করলে দেখতে পেতাম, শনি ঠাকুরের ব্যাপারী ফটো, শালু, থালা, খুচরো সমেত চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা মূলধন, বাজারের থলেতে ভরে, গুনগুন

গাইতে গাইতে লাভের টাকাগুলো পকেটে ভরে নিচ্ছে। তার না আছে শনির কোপের ভয়, না আছে রবি সোমের পরোয়া।

প্রবল মেঘ গর্জন, মূহুর্মূহু বিদ্যূত চমক তৎসহ ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনা। বাড়ির কর্তাগিন্নি একযোগে শুরু করলেন হরি মাধবের স্তব।

বাড়ির গাছে এই বছরের প্রথম ফল, নারকেল কি আম কি কুল বা অন্য যা কিছুই হোক, দেবতাকে নৈবেদ্য না দিয়ে খাওয়া যাবে না, কাউকে দেওয়া যাবে না।

কোন গাছ কাটার দরকার পড়েছে। বৃক্ষদেবতার কাছে করজোড়ে মাপ চেয়ে নিয়ে কেটে ফেললেই হল। যুক্তি তক্কে যাই না যে, আগে একটা বিকল্প বৃক্ষরোপন করি, তারপরেই না হয় গাছ কাটবো।

এক পানগুমটি দোকানদারের অকুন্ঠ স্বীকারোক্তি, সারাদিন তো লোকজনকে পান, দোক্তা, জর্দা, বিড়ি-সিগারেট খাওয়াচ্ছি, কোনটাও ভালো জিনিস নয়, তাই সকাল সন্ধ্যা ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই, যাতে পাপ না দেন (ঠাকুর ঠাকুরানীরা ঘুষখোর কিনা পাঠকই বলবেন)।

রেলের কোন শিলান্যাস কি, জলজাহাজ উড়োজাহাজের কোন কিছুর উদ্বোধন হোক, ধূপ জ্বালিয়ে, কাঁসর বাজিয়ে, নারকেল ফাটিয়ে মঙ্গল কামনা করছেন বিজ্ঞান শিক্ষিত চিফ ইঞ্জিনিয়ারের দল।

তারকেশ্বরই হোক কি বৈদ্যনাথধামই হোক, ভোলে বাবা কি জয় চিৎকারকারীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তরুন প্রজন্ম একে অ্যাডভেঞ্চারের চোখেই দেখছে নাকি ভক্তির চোখে দেখছে, বলা অসম্ভব। অন্যদিকে রেল এবং রাজ্য সরকার গ্রাফ এঁকে চলেছেন, এই বছরে কত তীর্থযাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধি হল। গঙ্গাসাগর নিয়েও একই কথা বলতে হয়। এরকম বহু উদাহরণ চেষ্টা করলেই খুঁজে পেতে অসুবিধা হবে না।

সেই বোকা গৃহস্থ আর চালাক চোরের কথা মনে পড়ে নাকি? যে গৃহস্থ, বাড়িতে চোরের ঢোকা থেকে, তার নিজের বালিশের তলা থেকে চাবি নেওয়া থেকে, আলমারি খোলা পর্যন্তও, শুধু দেখে গেল এবং তখনও ভেবেই যাচ্ছে যে 'দেখি না, এরপর কি করে?' ফল যা হবার তাই হল, চোর বাবাজী ধীরে সুস্থে গৃহস্থের লুঙ্গি খুলে পোঁটলা বেঁধে, দরজা হাট করে খোলা রেখে, বামাল বেরিয়ে গেল।

চোর নিরাপদ দূরত্বে গেলে (আসলে  গৃহস্থ নিজেকে নিরাপদ মনে করলে তবেই), তারস্বরে আর্তনাদ শুরু করল চোর, চোর বলে।

আস্তিক ভাই, কটা প্রশ্নের জবাব দেবেন প্লিজ? -
বিশ্বনাথ মুরমু
Nov. 25, 2024 | নাস্তিকতা | views:896 | likes:0 | share: 0 | comments:0

আস্তিক হলেন সেই মানুষ, যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। শুধু ঈশ্বর নয়, তিনি যাবতীয় দেব-দেবী, অপদেব, অপদেবীতেও বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যতীত বা দেব-দেবীর আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না, ঝরে না, মানুষের জগতের ভালো বা মন্দও হয় না, কোনও কিছুই ঘটে না। জাগতিক যাবতীয় ঘটনাবলী, তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছেতেই ঘটছে। সৃষ্টি, স্হিতি, প্রলয় ঈশ্বরের নিত্য লীলা ইত্যাদি। তেমনই ছোটখাটো অন্য অনেক ঘটনাবলীও ঈশ্বরের ইচ্ছা অথবা তার ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অবতার যথা, শিব, ব্রহ্মা, নারায়ণ, বিষ্ণু, সরস্বতী, লক্ষী, কালী, রাম, হরি, গরাম ঠাকুর, মারাংবুরু আদিদের ইচ্ছা ব্যতীত সাধিত হয় না। অর্থাৎ তিনি বা তাঁরা আছেন বলেই সব কিছু হচ্ছে।


নাস্তিক হলেন সেই মানুষ, যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। কোন দেব-দেবী, অপদেব, অপদেবীতে তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন যে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে বা বিজ্ঞানের নিয়মে যা ঘটা উচিত, সেইভাবেই যা কিছু জাগতিক ঘটনা ঘটে, ঘটে চলেছে। কোনও ঐশ্বরিক পূর্ব পরিকল্পনা বলে কিছু হয় না, হতে পারে না। ঠিক একইভাবে এটাও বিশ্বাস করে না যে ঈশ্বরের কোনও ক্ষুদ্র কনা বা অবতার বলে কিছু হয়, যাকে দেব দেবী বলে বিশ্বাস করতে হবে এবং তার পূজার্চনা বা জপতপ করলে কোনও অভিলাষ পূর্ণ হবে।


এই বারে, খুবই বিনীতভাবে এই প্রশ্নগুলি পেশ করছি। আর আশা করছি যে সৎসাহসের সঙ্গে আন্তরিকভাবেই কোনও আস্তিকবাদী ভাই এর যথাযথ উত্তরগুলি দেবেন।


- আমি যে নাস্তিক হব অর্থাৎ ঈশ্বরে বিশ্বাস করব না, এটা তাঁরই ইচ্ছা নয় কি? (যদি থাকেন)। কেন না, তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছা ব্যতীত কোনও কিছুই তো হওয়ার নয়।

- জাগতিক কোনও ঘটনাকেই ঈশ্বরের ইচ্ছা বা কীর্তিকলাপ বলে মনে করব না, মেনে নেব না, এও নিশ্চয় তাঁরই পূর্বনির্দেশ? (যদি থাকেন)।

- আপনি আস্তিক মানুষ হয়ে তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করবেন, দেব দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করবেন, তেমনই আমি নাস্তিক হয়ে তাঁর অস্তিত্বকে, মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করবো, এও তাঁর অসীম করুণা নয় কি? (যদি থাকেন)।

- আমাকে ব্যাখ্যা দিন, আপনার ঈশ্বর আমার মনে তাঁর নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেই এই অবিশ্বাস জাগিয়েছেন কেন?

- জাগতিক ঘটনাবলীর জন্য নিতান্ত যে প্রকৃতিই দায়ী এটাই বা আমার মনে আনলেন কেন?


যুক্তিবাদী ব্যক্তি, দল অথবা মঞ্চ বলে যা গড়ে উঠেছে, আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য যে, এর জন্যও আপনার ওই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই দায়ী (যদি থাকেন)। কিন্তু কেন?

- মানুষকে ঈশ্বরের নামে বোকা বানাবেন এটা যদি তাঁরই ইচ্ছা হয়, তাহলে তার প্রতিবাদ করাও তাঁরই ইচ্ছা, কি বলেন? ঈশ্বর কেন এমন ইচ্ছা করলেন?


মোরবি সেতু মৃত্যুকান্ডের (বলা উচিত হত্যাকান্ড) সেতু রক্ষণাবেক্ষনের কর্তারা বলেছেন যে ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে কেন তদন্তকারী দল তাঁদেরকেই দায়ী করেছে? আপনি স্বীকার করতে বাধ্য যে মোরবি দুর্ঘটনার অপরাধীদের কারাবাস নিশ্চিত, তাহলে এও নিশ্চয় তাঁরই ইচ্ছা!

আসলে আস্তিকেরা ইচ্ছে করেই মনগড়া এক ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা প্রচার এজন্যই করেন যে স্বল্পশ্রমে লেহ্যপেয় সহযোগে কেমন আয়েশী জিন্দেগি যাপন করা যায়।


আস্তিক ভাই, মানতেই হবে আপনার অথবা আপনাদের এলেম আছে বটে। শস্য উৎপাদন বা শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে বা দেশের যে কোনও উৎপাদনে গতর না খাটিয়েও দিব্যি পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে করে খাবার সুন্দর সহজ পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন। ধন্য আপনি, ধন্য আপনারা।


রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপরতলা থেকে নীচতলা পর্যন্ত এমনভাবে বজ্রআঁটুনি দিয়ে রেখেছেন যে বড় বড় নেতা/অভিনেতা, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতি থেকে কৃষক শ্রমিক সব আপনাদের মুষ্টিতে। সত্যিই, ঈশ্বরের অথবা দেবদেবীদের কৃপা ছাড়া এটা সম্ভব হত না (আপনার মতে আমার মতে নয়)।


সাধারন মানুষ যাতে প্রশ্ন না করে, প্রশ্ন করলেও যাতে এমন উত্তর পায় যা আপনাদের উদ্দেশ্যকেই পূর্ন করবে, তাই আপনারা ধর্মের নামে (তথাকথিত) ভালো ভালো অজস্র কেতাব রচনা করেছেন, আখড়া বানিয়েছেন, আশ্রম খুলেছেন, আশ্রমের শাখা-প্রশাখা খুলেছেন।


আমি বা আমরা বিনা প্রশ্নে কোনওকিছু মানতে রাজি নই। কে, কী, কেন, কেমন করে, কবে, কোথায় ইত্যাদি প্রশ্ন করার অধিকার মানুষের জন্মগত। আপনারা গোড়াতেই তাকে উপড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর, যুক্তি দেন ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। আপনারা তাই চান না যে মানুষ শিক্ষিত হোক। এই বিষয়ে আপনাদের ব্যাপক গবেষণায়, গবেষণালব্ধ ফল প্রয়োগে সত্যিই অবাক মানতে হয়। আপনারা দেখেছেন, মানুষ স্বচ্ছল হলে, স্বাবলম্বী হলে তারা শিক্ষালাভের চেষ্টা করে। তাই আপনারা আপনাদের আবিষ্কৃত ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’ ফর্মুলা প্রয়োগ করেন। ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না, মানুষ আর কোনওদিকে চোখ মেলে তাকাবার সুযোগই পায় না। আপনাদের বাবার আখড়া, মায়ের আখড়ার মাধ্যমে মগজ ধোলাই করে মানুষকে এটা বোঝাতে সক্ষম হন যে, তাদের নিজেদের পূর্বজন্মের অথবা পূর্ববর্তী প্রজন্মের পাপের ফলেই তারা গরীব এবং অশিক্ষিত। তাদেরকে এটা বোঝাতেও সক্ষম হন যে তারা একমাত্র ভগবৎ স্মরণেই মুক্তিলাভ করতে পারে।

সাধারন মানুষের যুক্তিবোধের প্রশ্নের উত্তরে, আপনারা সবই তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছা বলে চালিয়ে দেন। কেউ বেশি প্রশ্ন করলে, কোনও কিছু মেনে নিতে না চাইলে, আপনারা সংযম না রেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন এবং অকথা কু’কথা বলেন, অভিশাপ দিয়ে দেন।

- এ সবই কি তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছা বলেই চালিয়ে দিতে চান?

তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছে ব্যতীত যখন কিছু হওয়ার নয়, তখন আমি যে মাধ্যমিকে ফেল করব এও নিশ্চয় তাঁর বা তাঁদেরই ইচ্ছে! তাহলে, সেই কারণে আমার বাবা আমাকে বকবেন বা চাবকাবেন কেন? এটা কি তাঁর বা তাঁদের স্ববিরোধিতা হয়ে যাচ্ছে না? এ’তো জোড়াতালি দেওয়া যুক্তি। ঠিক যেন গাছেরও খাব আবার তলারও কুড়োব। বাহ্ আস্তিক ভাই, ধন্য আপনাদের যুক্তি।

সেরকম কোনও কিছু থাকলে, তাঁর বা তাঁদের ইচ্ছেতেই তো কোনও বিরুদ্ধবাদীদের থাকবার কথাই নয়। ফলে, কোনও সন্দেহ, কোনও প্রশ্ন ওঠবার কথাই ওঠে না। অথচ প্রশ্ন উঠেছে, উঠছে। তারপরেও কি আপনারা গোঁ ধরেই থাকবেন? তাছাড়া আপনাদের আর উপায়ই বা কি আছে? আপনাদের তাসের ঘর ভেঙে যাক, এটাতো আর চাইতে পারেন না! তাই, যেভাবেই হোক, একে রুখতে হবেই। হ্যাঁ মানছি, আপনাদের বনিয়াদ খুব শক্ত ভিতের উপরই দাঁড় করিয়েছেন। তবে, এটাও জেনে রাখুন, আজ হোক কি কাল হোক, দু’বছর কি দশবছর কি দু’শ বছর পর আপনাদের ভিত আমরা যুক্তিবাদীরা ভাঙবই ভাঙব। জেনে রাখুন, মানুষ জাগছে, জাগবেই আজ কি কাল।

অথ ধর্মকথা - এক সাঁওতালের উপলব্ধি -
বিশ্বনাথ মুরমু
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:2614 | likes:2 | share: 2 | comments:0

জ্ঞান হবার পর থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে মানুষে মানুষে অনেক তফাৎ আছে। প্রথম তফাৎটা আমরা বুঝতে পারি ভাষায়। যেমন কারও ভাষা সাঁওতালি, কারও ভাষা মুন্ডারি, কারও ভাষা বাংলা, কারও ভাষা হিন্দি, কারও ভাষা পাঞ্জাবি, কারও ভাষা অসমীয়া, কারও ভাষা গুজরাটি, ইত্যাদি (ভারতে অষ্টম তপশীলভুক্ত সর্বমোট ভাষার সংখ্যাই ২২টি। এর বাইরে আরও অজস্র ভাষা আছে)। দ্বিতীয় তফাৎটা হল জাতির। যেমন মুসলমান, পাঞ্জাবি, ওঁরাও, সাঁওতাল, বাঙালি, তামিল, ওড়িয়া, নেপালি, ইত্যাদি (এও আছে অজস্র)। তৃতীয় তফাৎ খাদ্যদ্রব্য ও খাদ্যাভ্যাসে। চতুর্থ তফাৎ পরনের কাপড়ে ও পদ্ধতিতে। পঞ্চম তফাৎ ধর্মাচরণে। দৈনন্দিন জীবনে যে যার গৃহকোনে কেমন ধর্মাচরণ করি, কোন ঠাকুরকে নাম করি, প্রণাম করি, তা হয়ত অন্যের কাছে অনেকটাই অজানা থাকে। কিন্তু সামাজিক জীবনে ধর্মীয় আচরণে যা চোখে পড়ে (জাহের থান, মন্দির, চার্চ, মসজিদ, ইত্যাদি), তা সত্যি করেই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দেয়, যে এই বিষয়ে তফাৎটা ঠিক কোথায়, কতখানি। ধর্মাচরণ নিয়েই বিশদ কথাবার্তা বলতে বসেছি। ধর্মাচরণ মানেই উপরের দিকে আঙুল তুলে কোনও এক মহা শক্তিধরের ধারণা পোষণ (ভিন্ন ভিন্ন নামে) এবং তার টুকরো টুকরো কিছু অবতারের তোষণ। এই আচরণের ক্ষেত্রে, কেউ কেউ কোথাও যায় না (আদিবাসীরা), ঠাকুর আছে কিন্তু কোন মূর্তি নেই, তাই ঘরে বাইরে মূর্তি রাখবার কোন দেবালয়ও নেই, তবে দেবস্থান আছে। তাদের মনে মনে জপ করে নিলেই হল। দেবস্থান আছে কোন গাছের গোড়ায়, খোলামেলা জায়গায়, আর সেখানে তারা যায় বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশেষ  বিশেষ পূজার আয়োজনে। একদল মানুষ বাড়িতে এক বা একাধিক ফটো, মূর্তি রেখে সকালে সন্ধ্যায় ধূপ, দীপে, অবোধ্য/দুর্বোধ্য মন্ত্র (মাতৃভাষায় নয়) আউড়ে পূজার্চনা করে। কারও আবার আলাদা একটা ঠাকুর ঘর বলেই থাকে। একদল মানুষ ঠাকুর প্রণাম করতে যায় মন্দিরে। কেউ রোজ যায়, কেউ আবার বিশেষ কোন তিথিতে, বিশেষ কোন পূজার দিনে। এখানেও আবার কথা আছে। সব মন্দিরে কিন্তু একই মূর্তি বা ঠাকুর থাকে না। বিশেষ বিশেষ মন্দিরে বিশেষ কোন ঠাকুর থাকলেও, কোন কোন ঠাকুরের আবার সচরাচর মন্দির দেখা যায় না। কোথাও আবার একই মন্দিরে সব ঠাকুরকে অর্থাৎ ঠাকুরের ফটো বা মূর্তিকে রাখা হয়। কোন কোন জায়গার ঠাকুরকে জাগ্রত বলা হয়(তাহলে ধরে নিতে হবে যে বাকি সব জায়গার ঠাকুর নিদ্রিত)। একই রকম উদ্দেশ্য নিয়ে আর একদল মানুষ যায় মসজিদে। আবার, হিন্দি, বাংলা, সাঁওতালি, মারাঠি, ইংরেজি বা আরও অন্য ভাষায় কথা বললেও, এবং জাতিতে আলাদা আলাদা হলেও, আর একদল মানুষ যায় চার্চে, যীশুখ্রীষ্টের কাছে প্রার্থনা করতে, যারা ধর্মে খ্রীষ্টান। আমাদের সাধারণ ধারনায় আমরা জানি যে, জাতি, ভাষা ও ধর্ম যেন একটা পারস্পরিক সম্পৃক্ত ব্যাপার। কিন্তু, এতে বোঝা গেল যে জাতি, ভাষা আর ধর্ম বিষয়টা সম্পৃক্ত নয়। 

জাতি, ভাষা একই থাকলেও, ধর্মটা যেন আলাদা আলাদা নামাবলীর মত গায়ে চাপানোর ব্যাপার। এবং এই আলাদা নামাবলীর অন্ধত্বে মানুষ একে অন্যের প্রাণ পর্যন্ত নিতে পারে।

ইদানিং, জাতি আর ভাষার অন্ধ বিরোধের সাথে যোগ হয়েছে ধর্মের। কারণটা এটাই যে, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যে আচরণ করে, তা বেশির ভাগটাই তার ধর্মীয় শিক্ষা থেকেই করে। ফলে, এক ধর্মীয় আচরণের মানুষের সাথে অন্য ধর্মীয় মানুষের আচরণের পার্থক্যের জন্য কখনও কখনও বেধে যায় সংঘাত। এর মধ্যে অসহিষ্ণুতা আছে, অজ্ঞতা আছে, নিজেকে শ্রেষ্ঠ অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা আছে, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু হবার কারণ আছে, এবং এখন নতুন সংযোজন হয়েছে রাজনৈতিক রং। আর এমনিতেই আমরা জানি, নিত্যদিন দেখে চলেছি রাজনৈতিক বিভেদ কতটা হীন, কদর্য হতে পারে। এতে আপনার, আমার, আমাদের যে অসুবিধা বা বিপদ, ধর্ম ও রাজনীতি এই দুই ধ্বজাধারীদের সেটাই সুবিধা। রাজনৈতিক বিভেদের কারণে, একই ধর্মীয়গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমাল হলে, রাজনৈতিক ফায়দার কারনে, অনায়াসে তাতে ধর্মীয় রং চড়ানো হয়। আবার, ভিন্ন ধর্মীয়গোষ্ঠীর মধ্যের গোলমালকে (কখনও এক ধর্মীয়, কিন্তু দুই ভিন্ন মতাবলম্বী গোষ্ঠীর মধ্যের গোলমালকেও), ধর্মীয় লাভের কারণে রাজনৈতিক বিভেদকেই দায়ী করা হয়(অন্তত সেরকম বোঝানোর একটা প্রচেষ্টা চলে)। এতে করে, এই দুই ব্যবসায়ী অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যবসায়ী এবং ধর্মীয় ব্যবসায়ীরা প্রভূত লাভবান হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্ম এবং রাজনীতি, এই দুটোই ব্যবসার জিনিস, তা যদি না হয়, তবে এই দুটোকেই অন্তত ব্যবসা হিসাবে ব্যবহার করা যায়। আদিতে, ধর্ম হয়ত মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল, যাতে মানুষ অন্যায় না করে সুখী হতে পারে। তেমনই রাজার রাজ্য শাসনের নীতি নির্ধারন হয়েছিল কল্যাণমূলক যাতে দেশের ও দশের কল্যাণ হয়। এখন রাজার জায়গা নিয়েছে মন্ত্রী পরিষদ।  অতীতে এই দুটোর প্রবর্তক ও প্রবক্তাদের যে উদ্দেশ্য ছিল, তার বর্তমান অবস্থা দেখলে তাঁরা হয়তো বা বুক কি কপাল চাপড়েই আত্মহত্যা করতেন, পরিণতি দেখবার কথা চিন্তাই করতে পারতেন না। কি ভীষণ "উল্টা বুঝলি রাম" অবস্থা।

পর্ব ২

বাংলায় বলা হয় যে ধর্ম নাকি এমন কিছু যা মানুষকে ধারণ করে থাকে। শব্দ বা উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যই যদি কোন অর্থ প্রকাশ করে, তাহলে ধর্মের ইংরেজি যা হবে বা আরও অন্য ভাষায় যা হবে, তা কি সেই ভাষার মানুষকে ধারণ করবে না? নাকি সেই সব মানুষকে ধারণ করতে অসমর্থ হবে? কারণ ইংরেজীতে তো ধর্মকে বলা হচ্ছে Religion. অবশ্য, এখন এমন অনেক তার্কিক পন্ডিত আছেন যারা আপনাকে আমাকে শব্দের মায়াজালে ঠিক বুঝিয়ে দেবে, যে তাতে ঠিক কি বোঝায়। তারা ঠিক ডিকশনারি ঘেঁটে ঘেঁটে r, e, l, i, g, i, o, n, সব কটা ওয়ার্ড এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলবে যে এইজন্যই কথাটাকে বলা হয়েছে রিলিজিয়ন। সে যাক। সাধারণ ভাবে আমরা ধর্ম বলতে যা বুঝি(আকাশের বুকে সর্বশক্তিমান কিছু থাকুক কি না থাকুক) তা হলো, সৎভাবে জীবন যাপন করা, অন্যায় না করা, মিথ্যা আচরণ না করা, লোভ না করা, বিবেকের নির্দেশ মেনেচলা, এইসব। এর বিপরীত ক্রিয়াকলাপই হলো অধর্ম বা পাপ। আর পাপের বেতন যে মৃত্যু সেও আমরা সবাই জানি। তবে কেন এত রকমের ধর্ম দেখা দিয়েছে? আর ধর্মে ধর্মে বিভেদই বা কেন? ধর্মে ধর্মে বিভেদও না হয় বুঝলাম। কোন কোন ধর্মের তো আবার নিজের মধ্যেই বিভাজন আছে। তারাও যে একে অন্যকে পছন্দ করে না বা এড়িয়ে চলে। যেমন, খ্রীষ্টানের রোমান ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট। ইসলামের সিয়া আর সুন্নি। বৌদ্ধধর্মের হীনযান আর মহাযান। জৈনের শ্বেতাম্বর আর দিগম্বর, ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে কোথাও একটা উদাহরণ পেয়েছিলাম এইরকম:-

- আপনি কি হিন্দু? 

- হ, হিন্দু।

- আমিও হিন্দু। আপনি বৈষ্ণব, নাকি শাক্ত?

- বৈষ্ণব।

- হরে কৃষ্ণ আমিও বৈষ্ণব। আপনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব, নাকি চৈতন্য বৈষ্ণব?

- চৈতন্য বৈষ্ণব।

- হরে কৃষ্ণ। আমিও চৈতন্য বৈষ্ণব।

- তো আপনি কি ইস্কনে নাকি শ্রী গুরু?

- ইস্কনে।

- হরে কৃষ্ণ, আমাদের দেশি ইস্কন নাকি বিদেশি ইস্কন?

- দেশি। 

- হরে কৃষ্ণ, আমিও দেশি।

এই উদাহরনে শেষ পর্যন্তই দুজনের মধ্যে মিল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, যদি দেখা যেত যে, তফাৎ হয়েই চলেছে হয়েই চলেছে, তাহলে কি আর তারা পরস্পরকে সহ্য করতে পারত? পারত না। মারামারি কাটাকাটি না লাগলেও, তারা পরস্পরের থেকে দুরে সরে যেত। কেননা, তারা জন্মসূত্রেই এই পারস্পরিক দূরত্বটা পেয়েছে, যে দূরত্বের উদ্ভাবক তাদের পূর্বসুরীরা।

কোনও কোনও ধর্মের আবার গ্রন্থ বা বই আছে। যেমন, ইসলামের আছে কোরান, বৌদ্ধের আছে ত্রিপিটক, খ্রীষ্টানের আছে বাইবেল, এইসব। অনেক ধর্মমতের তো কোন বইই নেই, তবুও তাদের জীবন ধারনে কোথাও কোন অসুবিধা আছে বলে তো মনে হয় না। বেশ কেটে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। আদিবাসীরা লেখাপড়ার ধারই ধারতো না, লিপিও ছিল না। তাই তাদের লিখিত সাহিত্য, বিঞ্জান, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদিই নেই, ধর্মগ্রন্থতো দুরের কথা। 

তবে বর্তমানে দৃষ্টিবিভ্রমে সাঁওতালদের অবস্থাও অন্যদের মত হতে চলেছে। সাঁওতাল এখন প্রতিভার অধিকারী হয়ে আর কিছু হতে না পারুক, বেশ কিছু 'গুরু' বেরিয়ে পড়েছে, তাদের চেলাও তৈরি হয়ে গেছে।


জৈনধর্মের কোন গ্রন্থ নেই। জাপানী শিন্টোধর্মেরও কোন গ্রন্থ নেই। ধর্মের উৎপত্তি কেন হলো, কেমন করে হলো? এর ধারণাই বা মানুষ করলো কেমন করে? একটু তলিয়ে দেখলে ব্যাপারটা মনে হয় কিছু ধরা বোঝা অসম্ভব নয়। অতীতের কথা যতটা যা জানা গেছে যে তাতে মানুষ নাকি একদা দলবদ্ধ, শিকারজীবি, যাযাবর জীবনযাপন করতো। কৃষির যুগ তখনও আসতে দেরী আছে। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ যখন যেরকম প্রকৃতির রুপ দেখেছে, তখন তাকে সেইভাবেই কল্পনা করে নিয়েছে। কখনও ভক্তিতে, কখনও ভয়ে রুপকল্পনা করে (নারী, পুরুষ, শান্ত, বদরাগী, কল্যাণকারী, অনিষ্টকারী, ইত্যাদি) তাকে নানারকম উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে এসেছে। তার আগের পর্যায় পন্ডিতরা যা বলেছেন, একেবারে গোড়ায় পুরাতন প্রস্তর যুগ, তারপরে নুতন প্রস্তর যুগ, তারপর লৌহযুগ, এইসব। একেবারে গোড়ার দিকের দলবদ্ধ শিকারজীবি মানুষ, শিকার করা পশুমাংস প্রত্যেকে সমানভাবে ভাগ করে কাঁচা চিবিয়ে খেত। আগুনের ব্যবহার শিখবার পর তারা তাতে ঝলসিয়ে বা পুড়িয়ে খেতে শিখল। এতে করে তারা দেখল যে পোড়া মাংস খেতে সুস্বাদু এবং সহজপাচ্য। তারপর ক্রমবিকাশের হাত ধরে মানুষ পরিবার বাঁধল এবং একসময় কৃষিজীবি হল। এবারেই সাম্যবাদী খোলস ছেড়ে মানুষ অসাম্যের জীবনে এসে পড়ল। শুরু হল তোমার, তোমাদের, আমার, আমাদের জীবন। আর তখন কোন কোন মানুষের ইচ্ছে জাগল যে, জাগতিক যা কিছু কাজের জিনিস, তা যেন 'তোমার' চেয়ে 'আমার' বেশি বেশি থাকে। অর্থাৎ লোভের সূত্রপাত। এবং এর ফলে একে অন্যকে ফাঁকি দিয়ে একটু বেশি সরিয়ে নেওয়া, অথবা ওকে কায়দা করে বেশি খাটিয়ে নিজে একটু আরাম করা (স্বার্থপরতা), এইসব এলো। জেনে বুঝে নিজের বিবেক লঙ্ঘন করে মানুষ শুরু করল পাপের প্রক্রিয়া (যার অবধারিত ফল হল দুঃখ)। যে একজন পাপ করলো, অন্য একজন হয়ত তা জেনেবুঝেও চেপে গেল, প্রতিবাদ করল না, বা প্রতিকার করার উদ্দেশ্য নিয়ে অন্য কারুকে জানালো না। তখন সেও কিন্তু হয়ে পড়ল পাপের ভাগিদার। এখন, সবকালেই কিছু কিছু মানুষ চিন্তায় ও কাজে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে যে বা যাদের মনটা ভালো এবং চায় যে সবার ভালো হোক বলে। সেরকম মানুষ কিন্তু উপলব্ধি করবে যে লোভের বশবর্তী হয়ে যারা অন্যায়, অর্থাৎ পাপ করছে, তার ফলেই কিন্তু সৃষ্টি হচ্ছে জাগতিক দুঃখ ও কষ্ট। তাই, তিনি হয়ত তাদের ভালোর জন্যই, মিষ্টি কথায় চিড়ে ভেজাবার প্রয়াস করলেন। তিনি মানুষের ভয় আর ভক্তিতে সৃষ্ট কাল্পনিক দেব অথবা দেবীকে দিয়ে কাজ হাসিল করবার চেষ্টা করলেন। তাঁর প্রয়াসে কিছুটা চিড়ে হয়ত ভিজল, কিন্তু সবটা নয়। অর্থাৎ লোভের বশবর্তী হয়ে যারা অন্যায়ের পথে পা বাড়িয়েছিল, কিছু হয়ত সংযত হল কিন্তু সবাই নয়। এবারে সেই যার মনটা ভালো, মানুষের ভালো চান, পরবর্তীতে তিনি কি করবেন? আগের মিষ্টি কথার বদলে, একটু একটু করে যষ্টি প্রয়োগ করবেন। কিছু নরম, কিছু গরম বাণীর সাথে সাথে বাধ্যতামূলক আচার অনুষ্ঠানের বিধান দিলেন। এবার দেখা গেল, ফল হল আগের চেয়ে ভালো। দেখা গেল যে অন্যায় কাজ অনেক কমে গেল, ফলে মানুষও অনেক ভালোভাবে জীবনযাপন করতে সক্ষম হলো। কিন্তু কথায় আছে না, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। পাপের পথে যে একবার পা বাড়ায়, পাপ তাকে নিত্য হাতছানি দেয় (পাপের পথ মসৃন)। কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই যথা পূর্বম তথা পরং। অর্থাৎ, আবার অন্যায়ের মাথাচাড়া দেওয়া এবং জাগতিক দুঃখকষ্টের বৃদ্ধি হওয়া। ফলে, আবারও আরো কোন একজন মানবহিতৈষী(ততদিনে আগেরজন হয়ত মারা গেছেন) মানব উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালালেন। তবে আগের জনের চেয়ে হয়ত আরও পৃথক বাণীতে, পৃথক পদ্ধতিতে। এখন সর্বকালেই আমরা বেশকিছু হুজুগে মানুষের দেখা পাই, যারা নতুন কিছু পেলেই হা রে রে রে করে মেতে ওঠে। নতুন মানবদরদীকে পেয়ে তাদের গুরু, গুরু রব ছাড়তে দেরি হল না। তারা জোর কদমে প্রচারের কাজ চালাতে লাগল। তারা একটা নামও দিয়ে দিল, ফলে উদ্ভব হলো নতুন এক ধর্মের। নামকরন হল, হয় গুরুর নামে নয়তো অন্য কোনো কিছু। তারা চাইলো অন্য সবাইকে এই গুরুর ছত্রছায়ায় আনতে, নিজেদের দলভারি করতে। কেউ আসতে রাজী হল, কেউবা হল না। যারা এল তারা অতি উৎসাহীর হাত থেকে বেঁচে গেল, যারা এলনা, তারা দুয়ো পেতে লাগল। এতে করে, একে অন্যকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা এল। ক্রমে ক্রমে এই এড়িয়ে চলা গিয়ে দাঁড়ালো বিরোধে এবং এই বিরোধ একদিন গিয়ে দাঁড়ালো প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে। এইভাবে যত গুরুর সংখ্যা বেড়েছে, মানুষে মানুষে বিভাজনও বেড়েছে। দাঁড়ালো গিয়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণের বাণীতে যা 'যত মত তত পথ'  এর মতো। অর্থাৎ সেই 'উল্টা বুঝলি রাম।' 

পর্ব ৩

মানুষের ভালো করতে গিয়ে হলো মন্দ। এবং এতে ইন্ধন যোগানোর কারিগর সব হলেন গুরুর চ্যালাচামুন্ডাগণ। তাঁরা চিরকালই সেই বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। এই প্রক্রিয়া যে কোনও একটা জাতি বা ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেই চলেছিল সেরকম নয়, ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেও চলেছিল। ফলে দিকু বা হিন্দুর ধর্মচেতনা একভাবে বয়ে চলেছিল, মুসলমান, শিখ, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, আরও অন্যান্যদের অন্য অন্যভাবে বয়ে চলেছিল। ফলাফল, বিভিন্ন নদীর তাদের শাখানদী, উপনদী নিয়ে একই সমুদ্র অভিমুখে, কিন্তু আলাদা আলাদা পথে বয়ে চলার মত। অন্তিমে নাকি সবারই স্বর্গপ্রাপ্তি। ইতিমধ্যে পূর্ববর্তী কোনও ধর্মমতের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় গুরু বা তারও পরের গুরুদের আবির্ভাব হয়ে গেছে। ফল, আবারও বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতার আরও একটা কারণ হলো, জাতি ও ভাষাসত্তা। এক জাতির যখন কোন গুরুর উৎপত্তি হলো, স্বাভাবিক জাতিসত্তার প্রবণতায় অন্য কোন জাতি হয়ত তাতে উদ্বুদ্ধ হলো না। এবং একসময় দেখা গেল, কোন এক সুন্দর সকালে তাদেরও নিজস্ব গুরুর আবির্ভাব হয়ে গেছে। অতএব, ষোলকলা পূর্ণ।

ধর্মীয় বিষয়ে উৎসাহ দিয়ে বা বিশেষ কোন দেবালয়ের বা পূজারীদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে, বিশেষ কোন রাজনৈতিক দল(ব্যাক্তিবিশেষও হতে পারে) ভোটব্যাঙ্কের ফায়দা তোলে, তুলতে পারে। কিন্তু, যেদেশে সরকার অথবা সরকারে থেকে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এইরকম কাজ হাতে নেয় এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে, বুঝতে হবে সেদেশের হাল কতটা দয়নীয় (অ-শিক্ষা, কু-শিক্ষা)। তাই দেখা যায়, দেশ গড়ার স্বার্থে এদেশে যেখানে অলি গলিতে লাইব্রেরি হওয়া দরকার, স্কুল হওয়া দরকার, শরীর গঠনের ক্লাব হওয়া দরকার, তার বদলে সরকারের তরফে না হলেও সরকারে থাকা কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের তরফে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য মন্দির, মসজিদ বা চার্চ বানাবার অথবা সংস্কার করবার কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে।

তাই মনে হয়, কার্ল মার্কস বাধ্য হয়েছিলেন বলতে যে ধর্ম হল জনগণের কাছে আফিমের মত, যার নেশায় তারা আচ্ছন্ন থাকে বা শাসক দ্বারা শাসন ও শোষনের স্বার্থে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়।

বলা হয় যে বর্তমান জীবনে যে যা হয়েছে, তা হয়েছে তার বা তাদের পূর্বপুরুষদের পূর্বজন্মের পাপ বা পূণ্যের কল্যাণে। প্রচার করা হয় যে মাথার উপরে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর/আল্লা/গড আছেন, যিনি সবার ভাগ্য নির্ধারন করেন। ফলে, মানুষের কোনও কারিকুরি সেখানে চলে না। মাথা পেতে ঈশ্বরের/আল্লার/গডের(প্রকারান্তরে রাজার। মর্ত্যভূমে তিনিই নাকি ঈশ্বরের অবতার) নির্দেশকে বিনা প্রশ্নে, সীমাহীন আনুগত্যে, বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়ে জীবনধারণ করতে হয়। কিছু স্বঘোষিত, ঈশ্বরের ঠিকাদারের দেখা পাওয়া যায় যারা ধনিক শ্রেণীর দালালি করে, গরিব শ্রেণীর মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে বেশ আয়েসে জীবন কাটায়। যুগে যুগে, দেশে দেশে, এই তন্ত্র বা সিস্টেম, এমন করেই প্রভুত্ব করে এসেছে যাকে রাজতন্ত্র বলে থাকি। 

এটা যদি সত্য না হয়ে থাকে, তবে যুগে যুগে, দেশে দেশে গণ আন্দোলন বা বিপ্লব বারেবারেই কেন দেখা দিয়েছে? ব্যাপারটা হলো প্রশ্ন করার, প্রশ্ন তোলার হিম্মতের, জবাব পাবার অধিকারের। এইখানেই শাসক শ্রেণী আর তার তাঁবেদারদের কৃতিত্ব যে তারা, কি কি পদ্ধতিতে কেমনভাবে এই মুক্তচিন্তার প্রশ্নের গলা টিপে ধরতে পারে বা পেরেছে। আজকে ভাষাবিদ্যার প্রয়োগে মিষ্টি মোড়কে যাই নাম দেওয়া হোক না কেন, সারা পৃথিবীতেই একই মানসিকতার, একই জিনিসই চলছে। হ্যাঁ, যুগের সাথে ভাবনার একটু রদ বদল তো অবশ্যম্ভাবী। বর্তমানে, শাসকের শীর্ষনেতাকে রাজার বদলে কোথাও প্রধানমন্ত্রী বলা হয়, কোথাও বা প্রেসিডেন্ট বলা হয়। আর, এখন একা খাওয়ার বদলে পাঁচ পাঁচ বছর করে একদল লোককে যথেচ্ছ জীবন যাপনের সুযোগ করে দেওয়া হয়, ধনাঢ্য করে তোলা হয়(পোষাকী নাম মন্ত্রীসভা)। তারা নাকি শর্তসাপেক্ষে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত(নির্বাচনের আগে ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দেয়)। কিন্তু জনগণ যখন শর্তের কথা তোলে, তখন তাদের উপর বর্ষিত হয় লাথি, ঝাঁটা, কিল, চড় নয়ত গিলি গিলি ফুঃ, হাপ্পিশ। এই সিস্টেমের পোষাকী নাম নিশ্চয় বলতে লাগবে না যে এ হল গণতন্ত্র। সে যাক। কথা হচ্ছে ধর্মের। পাঠক, চিন্তা করুন ধর্মের উদ্দেশ্য নাকি মানুষের আত্মিক উন্নতির। সেখানে গেরুয়া পরে, কি সাদা কাপড় পরে, কি লাল কাপড় পরে, কি হলুদ কাপড় পরে, কি কাপড় না পরেই(উলঙ্গ থেকে), কি পাগড়ি পরে, কি দাড়ি না কেটে, কি পূর্বদিকে প্রণাম করে, কি পশ্চিমদিকে প্রণাম করে, কি আত্মিক উন্নতি হয়, বোঝা দুস্কর। এ তো ব্যবধানই সৃষ্টি করা হলো। হিংসা না করা, লোভ না করা, অন্যায় না করা, অন্যায় সমর্থন না করা(তেমনই অন্যায়ের প্রতিবাদ করাও), মিথ্যা না বলা, কু চিন্তা না করা, ইত্যাদি সৎ কর্মের জন্য কোন উপচারের প্রয়োজন আছে কি? আসলে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় চেলারা, তাদের কেউ কেউ আবার ততদিনে প্রমোশন হয়ে নিজেরাই গুরু বনে গেছে, তারা দেখেছে যে যত উপচার, তত টু পাইস প্রফিট(দুগ্ধে, ঘৃতে, চর্বচোষ্যে এলাহাবাদ কান্ড)। করতে করতে আজ শিশু চারাগাছ মহীরুহ, এমনকি মহীরুহ ছড়িয়ে পড়েছে শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও। তেমনই, বিদেশের বিভিন্ন ধর্মমত সেখানকার মাটিতে আটকে না থেকে (ধর্মের তেজ বলে কথা) এদেশেও মহীরুহ হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের কি রমরমা, চিন্তা করা যায় না, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। যে যে ধর্মগুরুরা বিভিন্ন কেস খেয়ে ফেঁসে আছেন (নজরবন্দী বা জেলে আছেন), তাদের কর্মকান্ড নিয়ে একটু খবর নিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন (যারা ফাঁসেন নি তাদেরও  বুঝতে পারবেন)। তারা আপনাকে, আমাকে বলে ত্যাগের কথা, তারা আমাদের শেখায় মায়াবাদ। 

পর্ব ৪

কথা হলো, এর থেকে বেরিয়ে আসার কি কোন উপায় নেই? (বেরোতে দিলে তো বেরোবে? বেড়াজাল বিছানো আছে চতুর্দিকে)। বেরোবার উপায় থাকবে না কেন, অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই যে বলে, লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে? অধিকাংশ মানুষই চায়, যেমন আছে চলতে দাও, কোন পরিবর্তনের দরকার নেই। হ্যাঁ, এটা বা এরকম চলতে পারে ততক্ষণ, যতক্ষণ না বিশেষ কোন ক্ষমতাবান মানুষ বা সম্প্রদায়কে আঘাত করছে বা তাদের ক্ষতি করছে। যদি ক্ষমতাবান শাসকদের বা তাদের আপনজনদের ক্ষেত্রে এরকম দেখা যায়, তবে অচিরেই দেখা যাবে পরিবর্তন এসে গেছে। অ্যাট এনি কস্ট, সামহাও তারা পরিবর্তন আনবেই। কিন্তু অর্থনৈতিক, শিক্ষানৈতিকভাবে দুর্বল, ভীরু, শতধা বিভাজিত, শাসিত আর শোষিতের বেলায়? দেখা যায়, প্রসঙ্গটা কে তুলবে, সেই লোকেরই দেখা পাওয়া না। জনমত, আন্দোলন, বিপ্লব তো বহুত দুর কি বাত। তাই মানুষের ধর্মবিশ্বাসে লাভবান শ্রেণী, কোনদিন কখনও চায়নি এবং এখনও চায় না যে এই গোলকধাঁধা থেকে মানুষ বেরোক। ধর্মকে শিরদাঁড়া বানিয়ে চলছে বিশ্বব্যাপী বিশাল বাণিজ্য লহরী। একটা উদাহরন দিই। ধরেনিন কোনও একটা মন্দির/প্যাগোডা/মসজিদ/চার্চ/গুরুদ্বারা, ইত্যাদি। কেউ ভক্তিতে প্রণাম করতে গেলে প্রণামি দিতে লাগে (যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এসব জায়গায় প্রণাম করলে পূণ্য অর্জন করা যায়। পূণ্য করবো কেন? না, আমাদের জন্মই হয়েছে পাপের মধ্যে দিয়ে। আমরা জন্মপাপী। তাই আমাদের পূণ্য অর্জন করতে হবে, দান ধ্যান, পূজো ব্রত, ইত্যাদি কাজের মধ্যে দিয়ে)।এতে বিশেষ প্রতিষ্ঠানের যে সেবক/সেবকেরা নিয়োজিত/লিপ্ত আছে তার/তাদের সরাসরি লাভ বা উপার্জন। শুধু প্রণামি দিয়ে প্রণাম সারলে আবার চলবে না। একটা মোমবাতি অথবা কটা ধূপকাঠি জ্বালাতে লাগবে। সে সব সাজিয়ে কাছেপিঠেই বসে আছে সেবকের ভাই বিরাদারেরা। তাদেরও টু পাইস লাভ। হতে পারে, তাদের বিক্রির একটা অংশ কমিশন হিসেবে সেবককে/সেবকদের দিতে লাগে। তেমনই, কোথাও আছে ফুলের, মালার, চন্দনের দোকান, কোথাও বাতাসা নকুলদানার দোকান, আরও আছে চাদরের দোকান, মোমবাতির দোকান, কলা, আপেল, আঙুর, নারকেল, ধূপ-ধুনো, ইত্যাদি যথাবিহিত উপচার। অর্থাৎ, পুরোপুরি একটা সাজানো গোছানো বাজার। এখন কেউ যদি চক্রবৎ চলতে থাকা এই বাজারটা ভাঙতে যায়, সে কি রেহাই পাবে এর পৃষ্ঠপোষকদের হাত থেকে? এভাবেই শুরু হয়েছিল এবং চলে আসছে ভাগ্যবাদীদের নিয়ে প্রবাল, গোমেদ, চুনী, পান্নার রঙীন পাথরের ব্যাবসা। এভাবেই চলছে কবচ বা তাবিজের ব্যাবসা। ইদানিং এসেছে লাকি বাম্বু (কার জন্য লাকি? জনসাধারণের পেছনে আনলাকি বাম্বু), লাফিং বুদ্ধ (জনগন বুদ্ধু), জাম্পিং ফ্রগ, ইত্যাদি। কিন্তু কে শোনে কার কথা? অর্থনৈতিক পরাধীন, চিন্তাচেতনায় পরাধীন মানুষ, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোতেই বিশ্বাস করে। বর্তমান জগত, বিশ্বাসের জগত, যে বিশ্বাস কমছে না বরং বেড়েই চলেছে, যুক্তি যেখানে কাজ করে না, কাজ করতে দেওয়া হয় না।  এই বিষয়টা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব সুন্দর করে বলে গেছেন তাঁর একটা কবিতায়। শোনা যাক:-সর্বহারা অবিশ্বাসী

আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রী, বেশ সেজেগুজে এসেছে/

কিন্তু আমাদের সঙ্গে খেতে বসবে না/

আজ তার নীলষষ্ঠী/

যৌবন বয়সে এই নিয়ে কত না চটুল রঙ্গ/ করতাম/

এখন শুধু একটা পাতলা হাসি,/ অন্যের বিশ্বাসে নাকি আঘাত দিতে নেই/ আর এক বন্ধু, যে প্রথম আমায় ছাত্র/ রাজনীতিতে টেনেছিল/ তার আঙুলে দেখি একটা নতুন পাথর-বসানো/ আংটি/ আমার কুঞ্চিত ভুরু দেখে সে দুর্বল গলায় বলল/ শরীরটা ভালো যাচ্ছে না,/ তাই শাশুড়ি এটা পরতে বললেন, মুনস্টোন/ না বলা যায় না/ আমার মনে হল, এ যেন আমারই নিজস্ব পরাজয়!/ শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের বাড়ি, মাঝে মাঝে যাই তাঁর/ আলাপচারী শুনতে/ এখনও কত কিছু শেখার আছে/ আজই প্রথম দেখলাম, তাঁর দরজায় পেছন/ দিকে,/ গণেশের মূর্তি আটকানো/ প্রশ্ন করিনি, তিনি নিজেই জানালেন,/ দক্ষিণ ভারত থেকে ছেলে এনেছে, কী দারুণ/ কাজ না?/ সুন্দর মূর্তির স্থান শো-কেশের বদলে দরজার/ ওপরে কেন/ বলিনি সেকথা, সেই ফক্কুড়ির বয়েস আর নেই/ বয়েস হয়েছে তাই হেরে যাচ্ছি, অনবরত হেরে/ যাচ্ছি/  অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই, অন্যের/ বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই/ চতুর্দিকে এত বিশ্বাস, দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে কত/ রকম বিশ্বাস/ যে গেরুয়াবাদী ঠিক করেছে, পরধর্মের শিশুর/ রক্ত/ গড়াবে মাটিতে, চাটবে কুকুরে/ সেটাও তার দৃঢ় বিশ্বাস/ ধর্মের যে ধ্বজাধারী মনে করে, মেয়েরা গান/ গাইলে গলার নলি/ কেটে দেওয়া হবে/ টেনিস খেলতে চাইলেও পরতে হবে বোরখা/ সেটাও তার দৃঢ় বিশ্বাস/  যে পেটে বোমা বেঁধে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে/ যে পেশি ফুলিয়ে, দেঁতো হাসি হেসে/ পদানত করতে চাইছে গোটা বিশ্বকে/ এরা সবাই তো বিশ্বাসীর দল/ সবাই বিশ্বাসী, বিশ্বাসী, বিশ্বাসী.../ এক একবার ভাঙা গলায় বলতে ইচ্ছে করে/ অবিশ্বাসীর দল জাগো/ দুনিয়ার সর্বহারা অবিশ্বাসীরা এক হও!


তবুও, পৃথিবীর ইতিহাসে পরিবর্তনও হয়েছে (তবে উপযুক্ত মূল্য দিতে হয়েছে)। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস, ভারতের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস, নিজেদের ইতিহাস পড়বে কে? যাদের পড়া দরকার, যাদের পরিবর্তন দরকার, তাদের কতজন লিখতে পড়তে পারে, কতজন নিরক্ষর তারা নিজেরা কি সে খোঁজ রাখে? ইতিহাস বলে যা পাই, পড়ি, তা কি প্রকৃত ইতিহাস? যাইহোক, ভারতে ইংরাজের প্রভুত্বকালে ইংরাজ মিশনারীগন জ্যাকপট লাভ করে সাঁওতাল বা সাঁওতালদের মত নিরীহ, গোবেচারা আদিবাসীদের পেয়ে (অন্যান্য ভারতীয় জাতিও ছিল)। ফলে, সাঁওতালদের নন্ খ্রীষ্টান আর খ্রীষ্টানের মধ্যে এল বৈরিতা, সন্দেহ, এইসব এবং তা এখনও প্রবহমান (এমনিতেও সাঁওতালদের মধ্যে সারিধরম আর সারনাধরম বলে, দুই ধর্মমতের প্রবাহ অনেককাল আগে থেকেই চলে আসছে)। ইংরাজ মিশনারি বলে কথা, তাদের ব্যাবস্থা একেবারে নিখুঁত(গীর্জা প্রথা)। কেউ বেরোতে চাইলেও পারবে না, বরং আড়কাঠি হয়ে তারা চেষ্টা করে নতুন নতুন সাঁওতালদের (অন্য আদিবাসীরা অন্য স্ব-জাতীয়দের) নিজেদের দলে ঢোকাতে। ইদানিং আবার শোনা যাচ্ছে যে সাঁওতালি যে পরব, গান বাজনা তারা একদা ত্যাগ করেছিল, বাদ্যযন্ত্র সহকারে সাড়ম্বরে তাই তারা অনুষ্ঠিত করছে (এরমধ্যে নতুন কি চাল আছে কি নেই, কে বলতে পারে? আমি তো বলতে পারব না। সাঁওতাল খ্রীষ্টান কি কম পড়িয়াছে? বিশ্বের খ্রীষ্ট সমাজ সুদুর ভ্যাটিকান থেকে পরিচালিত হয়, আপনি আমি কোন মহাজন যে তা বুঝতে পারব?) তবে,

পৃথিবীতে এখন মানুষেরই বড় অভাব। পৃথিবী ভরে গেছে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, পারসী, জৈন, সারিধরম, সারনাধরম, ইত্যাদি  ইত্যাদি ধর্মাবলম্বীতে। আর এই তথাকথিত ধার্মিকরা, একদা মহান ও সুন্দর পৃথিবীতে হানাহানি, রক্তপাত, খুন, ধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নি সংযোগ, ভেদাভেদ আর হিংসারই আমদানি করেছে। পৃথিবী তাই আর সুস্থভাবে বাসযোগ্য নেই। সেটা করতে হলে, যুক্তি মনস্ক, বিজ্ঞান মনস্ক, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, বিবেকবান, মানবিক মূল্যবোধের লোক চাই, স্বাভাবিক জীবন যাপনে যারা মানুষ হয়ে উঠবে এবং অন্যদের করে তুলবে।


পর্ব ৫

যুক্তিবাদী হওয়া সত্বেও, ব্যাক্তিজীবনে অনেকেই কিন্তু প্রকৃতই দ্বিচারি জীব(আমিও তাই)। মুখে বলে ঠাকুর দেবতা মানি না, ধর্ম মানি না, ভাগ্য মানি না, জ্যোতিষ মানি না, লাল সূতো, কবচ তাবিজ, পাথর - শিকড় মুর্দাবাদ, কিন্তু সেই তারাই হয়ত রাত জেগে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরে, ঈদে বা দশমীতে কোলাকুলি করে, প্রণাম করে। সাঁওতালের 'আবগে বঙ্গা'য় গ্রামের লোকের সাথে বাৎসরিক পিকনিক করে, মারাংবুরুর নামে জাহের থানে মুরগি মানত করে, আরও কিছু করে (আমিও)। আসলে, তারা এ সবের বিকল্প এখনও খুঁজে পায়নি, যা সফলভাবে এক জাতির সব মানুষকে, অথবা যে কোন জাতিরই প্রতিটি মানুষকে মেলাতে পারে ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে। ততদিন যুক্তিবাদী হয়েও ঐসব সহ্য করে চলেছে, মেনে চলেছে নেহাৎ নিরুপায় হয়েই। কারণ, এখনও পর্যন্ত তারা এমন কিছু ভেল্কি আবিস্কার করতে পারেনি, যা আবালবৃদ্ধবনিতা, আপামর জনসাধারনকে ভুলিয়ে, আনন্দ দিয়ে একত্র রাখতে পারে। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত তারা খুবই  সংখ্যালঘুও বটে। অন্যদিকে, যে কোন মনুষ্য সমাজেই, শিশুর জন্মের সময় থেকেই তাকে  দেবদেবী, কবচ তাবিজ, শিকড় পাথর, অলৌকিক, অতিলৌকিক, ভৌতিক, দৈবী ইত্যাদির বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেফেলা হয়। যুক্তিবাদী হতে কোন একটা মানুষের কমপক্ষে অন্তত ২৪/২৫ বছর বয়স পর্যন্ত সময় লেগে যায়, যেতে পারে। কানে শুনে বিশ্বাস করার পরিবর্তে, গুরুদেব বলেছেন বলে বিশ্বাস করার পরিবর্তে, যুক্তির উত্তর চাইলেই নাস্তিক, পাখন্ডী, ইত্যাদি কথা শুনতে হয়। স্বাভাবিক কৌতূহলেও কেউ যুক্তির কথা জানতে চাইলেও রে রে করে চতর্দিক থেকে আক্রমণ ধেয়ে আসে (মা, বাবা, ভাই, বোন, ঠাকুমা, দাদু, পিসি, মাসী, মামি, কাকিমা, জেঠিমা, পাড়ার দাদু, কাকু, জেঠা, ইত্যাদি ইত্যাদি)। তবুও বলবো, মানুষের যুক্তিবোধ সংখ্যায় কম হলেও বেড়ে চলেছে, বাড়তেই থাকবে যদি না তারা বাধ্য হয় এবং ধান্দাবাজদের খপ্পরে বা ফাঁদে পড়ে। বহু যুক্তিবাদীদের ক্ষেত্রে তো লাইফ থ্রেটনিং পর্যন্ত  হয়ে গেছে। কেউ বা শহীদও হয়ে গেছেন। তবুও, সুখের অন্তত একটা বিষয় হয়েছে যে কয়েক বছর যাবৎ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের ধর্মের কলামে বিভিন্ন ধর্ম উল্লেখের সাথে সাথে 'মানবতা' কেও উল্লেখ করে চলেছে, অনেকের মতেই একমাত্র যেটা হওয়া উচিৎ। ধর্ম যদি আড়ম্বর সর্বস্বই কিছু হয়, তবে বলবো, রজনীশই একমাত্র সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন, আর তা হলো ভোগের মধ্যে দিয়ে ত্যাগের রাজ্যে উত্তরণ। তাঁর মতে, যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সে আবার কি ধর্ম করবে? ধর্ম করতে হলে বা ধর্ম পালন করতে হলে ধন থাকা চাই। তবেই না কেউ ভোগ করতে করতে একসময়  ত্যাগের রাজ্যে পৌঁছবে! যার মনে সবসময় কামনা রয়েছে, বাসনা রয়েছে, জাগতিক সামগ্রীর জন্য লালসা রয়েছে, তার পক্ষে ত্যাগী হয়ে মোক্ষলাভ একান্তই অলীক ব্যাপার। ভালোভাবে ধর্ম পালন করতে হলে তো আড়ম্বরও তদনুরুপ হতে হবে। জপতপের ভালো জায়গা চাই (উত্তম ইট, বালি, সিমেন্ট, মার্বেল, টাইলস্ এর ইমারত), একটা মূর্তি চাই বা মূর্তি না হলে লোকের চোখে ধাঁধা লাগানোর মত অনুরুপ একটা উপাদান চাই, ঢাক চাই, কাঁসি চাই(কখনও খাসিও চাই), উত্তম বস্ত্র চাই, আসন চাই, ধুপধূনো, কোশাকুশি চাই, ফুল চাই, মালা চাই, আতপ চাল ধান দূর্বা চাই, আপেল কলা (সব কলা আবার ঠাকুরের পেটে সহ্য হয় না), নকুল দানা, বাতাসা, ঢাক ঢোলের আওয়াজ, মাইক বক্সে তাকে দশগুন বাড়িয়ে পরীক্ষার্থী, হার্ট পেশেন্টদের অসুবিধা করে আড়ম্বর করা চাই। অর্থাৎ কিনা ধমাকেদার দেখনদারি চাই (ব্যবসা চলবে না কেন বলুন?)। সত্যিই তো, গরীবের দম কোথায় এমনভাবে কোনও ঠাকুরের (বা ভগবানের) সেবা করার, ধর্ম পালন করায়? রজনীশ তো তাহলে ঠিকই বলেছেন। তা সত্বেও বলছি, মন্দির, মসজিদ, চার্চ, প্যাগোডা, অবতার, ঠাকুর, এসব যদি সত্যি হত, প্রসাদ কি চরণামৃত খেয়ে কখনও ভক্তদের ভেদবমি হত না, হাসপাতালের চিকিৎসায় তাদের ভালো হতে হত না। কখনও চোর বাবাজীরা মন্দিরের সামগ্রী, মূর্তির গায়ের সোনারুপোর অলঙ্কার চুরি করে, কখনও হয়ত বহুমূল্য মূর্তিটাকেই চুরি করে নিয়ে যায়, অথচ কোন ঠাকুরের ক্ষমতা হয় না তাদের আটকাতে। ঠাকুরের অভিশাপে না হয় তাদের প্যারালিসিস কি ওলাওঠা, না হয় তাদের ভেদবমি (এই কারনেই যুক্তিবাদীরা অন্তর থেকেই অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী নয়, শুধুমাত্র উৎসবে বিশ্বাসী যা মানুষে মানুষে মিলন আনে, বিভেদ ঘটায় না)। 

এতসব বুঝেও, তা সত্বেও সাড়ম্বরে ঠাকুর পূজো করতে হবে, ধর্মস্থান বানাতে হবে, লক্ষ লক্ষ থেকে কোটি টাকার বাজেট রাখতে হবে, নতুন নতুন দেবস্থান গড়তে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার চাঁদা তুলতে হবে, চাঁদা না দিলে পেটে লাথি মারবো, হাত ভেঙে কোলে তুলে দেব, ইত্যাদি।

 A জাতি ধর্মের সামাজিক, দৈবিক কাজে যদি B দল আপত্তি করে, বাধা দেয়, হুকুম মত চাঁদা দিতে না চায়, ওদের মহল্লায় রাতে পেটো ঝাড়বো, কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেবো, ইত্যাদি। আমাদের চেনো না তো বাছাধন, বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়বো। আমরা পরম ধার্মিক বলে কথা(অহিংসা পরমো ধর্ম)। কাজেই আর বেশী বক্তব্য রেখে লাভ কি? অর্থনীতিবিদরা দোহাই দেবেন, কি দরকার, চলতে দিন না মশাই যেমন চলছে। দেখছেন না কি, অন্ধবিশ্বাস কি বিশাল একটা শিল্প ও বাণিজ্য। এইসব পুরোহিত, বাবাজী, গুরুজী, ধর্ম, ঠাকুর, মূর্তি, ভাগ্য, পাথর আছে বলেই না সারা রাজ্যে কি সারাদেশে ধনী থেকে গরীব কেমন করেকম্মে খাচ্ছে। দেখুন কেমন খড় শিল্প বেঁচে আছে, বাঁশ শিল্প বেঁচে আছে, মাটি শিল্প বেঁচে আছে, রং শিল্প বেঁচে আছে, শোলা শিল্প বেঁচে আছে, ফুল শিল্প ফল শিল্প বেঁচে আছে, দূর্বা ঘাস- বেলপাতা শিল্প আছে, বাতাসা নকুলদানা শিল্প বেঁচে আছে, সন্দেশ মিষ্টি শিল্প বেঁচে আছে, ছাগল-গোরু-উট শিল্প (বলি দেবার জন্য) বেঁচে আছে, লাল শালু শিল্প গামছা শিল্প ধুতি শাড়ী শিল্প বেঁচে আছে, ঢাক শিল্প (শিল্পীও) বেঁচে আছে, শ্যামা সঙ্গীত শিল্প বা ঠাকুর বন্দনা শিল্প বেঁচে আছে(সঙ্গে হারমোনিয়াম, তবলা শিল্প আছে, গীতিকার সুরকার আছে), নৃত্য শিল্প আছে, ঠাকুরের ছবি আঁকা শিল্প আছে, ঠাকুরের মালা- লকেট শিল্প আছে, নাটক-সিনেমা আছে, কাব্য সাহিত্য আছে, ঠাকুরের গানের কলার টিউন আছে, ইত্যাদি। এখনকার থিম পূজোর জন্য কোন শিল্পটা যে বাদ আছে,  এমন হয়ত খুঁজেই পাওয়া  যাবে না। রঙীন বেলুন হতে পারে, কাঁচের বোতল হতে পারে, কোল্ড ড্রিংসের বোতল হতে পারে, তালা চাবি, কলম, লন্ঠন, করাত কাটারি, চুলের কাঁটা বা ফিতেও হতে পারে। কখন যে কোনটা থিম হবে আপনি আমি পাত্তাই পাবো না। 

অন্যদিকে কট্টর  যুক্তিবাদীরাও কে যে কখন সুবিধাবাদী হয়ে প্ল্যাটফর্ম বদল করতে পারে, তাই বা কে বলতে পারে? চোখের সামনে যখন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের সই করা রাশি রাশি সার্টিফিকেটের হাতছানি আসবে, তখন যে কেউই এই যুক্তিই দেখাতে পারে যে, যুক্তিবাদ মে ক্যা রক্খা হ্যায় য়ার! মওকা মিলা হ্যায় আও, কামালো কামালো। আর কারও সামনে যদি বারো ইঞ্চি মাপের স্টিলের চকচকে ফলা তুলে ধরা হয়? যারজন্য প্রতিবাদী চরিত্ররা চিরকাল সলমন রুশদী হয়ে খোলামঞ্চে ছুরি খেয়ে যাবে, এতে আর অবাক হবার কি আছে? তা সত্বেও জোর গলায় বলা চলে, ধর্ম ব্যাবসায়ী, ভাগ্যবাদী অথবা জাতপাতের বিভেদকামীদের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, মানবতা ধর্মের ডক্টর দাভোলকরদের হত্যা করা গেলেও, তাদের আদর্শকে কোনভাবেই হত্যা করা যায় না, যাবে না।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929